23.12.20

ঠিকানাহীন চিঠি


পরম
প্রিয় অরিন্দম,

                                       চারপাশে একটা দম বন্ধ করা পরিস্থিতি। মনে হচ্ছে অদৃষ্ট যেন কালো কাপড়ে ঢেকে দিয়েছে সবকিছু। মনে হচ্ছে কেউ যেন অন্ধকার একটা ঘরে আটকে রেখেছে। কোনো দিকে যাওয়ার জো নেই তবুও আমি তোমায় চিঠি লিখছিএকটা ঠিকানাহীন চিঠি

অরিন্দম এমন কেন করলে?  কেন নিজেকে আড়ালে রাখছ? কেন নিলে স্বেচ্ছায় নির্বাসন? কেন কিছু বলো নি আমায়?  যদিও তুমি কিছুই বল নি কোনোদিন কখনও। তুমি বলেছ –‘ বলার কি আছে?’ বলার কি কিছুই থাকে নাপ্রকাশ শব্দ তোমার অভিধানে নেইকিন্তু কত বোঝা যায় বলতোএই কানগুলো শুনতে চায় কথা তবে কিছু যে বল নি তা নয়, বলেছ। যেদিন আনত মুখে তোমার জন্য অপেক্ষায় , ঘরের দরজা ঠেলে বলেছিলে কাছে এসআমার কানে যেন সহস্র শব্দ তীরের বেগে খেলে গিয়েছিলচোখের সামনে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিলসেই স্মৃতি আজও হলুদ হয় নিকিন্তু একি হলো তোমার?  নির্বাসনে যদি যেতেই হয় আমিও যাবোশ্রীরামচন্দ্র কি একা গেছিলেন সীতা মা তো সঙ্গে ছিলেনকিন্তু তুমি বললে-‘ না শ্রীতমা আমাকে একাই যেতে হবে।' আমি যাই নিআমি ঘরে একাকীভোরবেলায় এক কাপ চা নিয়ে বসি আমার বারান্দায়তুমি ভাবছ এখনও সকালে ওঠার কি আছে? আগে উঠতাম তোমার ডিউটির জন্য, এখন অভ্যেসমানুষ যে অভ্যেসের দাসচা খেতে খেতে আমার চার বাই ছয়ের বারান্দায় ঘুরপাক খাইগাছে জল দিইদশটা বাজে রান্না বসাই চাল ডাল আলু সেদ্ধ হয়প্রেসারে সিটি পরে আমার মনে পড়ে আমাদের প্রথম দেখা হওয়াএক  সরস্বতী  পুজোয় বইমেলার নাম করে তোমার সাথে কাটানো পড়ন্ত বিকেল। কিংবা সোনাঝুড়ির মাঠে কোনো এক দোলে দুজনের হারিয়ে যাওয়া আবিরের রঙেসেই রঙের প্রতিটি সোহাগ লেগে আছে নীল ডুরে শাড়ীতেসেই শাড়ী এখন আলমারির তাকে কাঁদছে

 দুপুর গড়ায় বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকে কবিতারাতারা হেঁটে চলে আমার শরীর জুড়ে। আমার ঠোঁটের গভীরে স্বরকে স্পর্শ করে । চোখের গহ্বরে জেগে ওঠে চোখতোমার চোখ আমি অনুভব করি , অনুভব করি ঘ্রানকোনও এক শীতের আচারি দুপুরে নিবিষ্ট হয়ে ছিলাম দুজনেনারকেল পাতার ছায়ায় ভেসে উঠেছিল তোমার খোলা বুকঝড়ের রাতে আমি এখন ওই বুক খুঁজিএক এক করে দিন কাটেস্মৃতিরা পিছু হাঁটেতুমি বলেছিলে –‘ সেবাই আমার ব্রত’। আমি প্রশ্ন করেছিলাম-‘ কেন তুমি ডাক্তার বলে’? তুমি বলেছিলে –‘ শ্রীতমা আমার কাছে এসো না এই ভাইরাস মারাত্মকযদি শরীরে বাসা বাঁধে শেষ করে দেবে সব’।

আমার মনে আছে যেদিন তুমি হসপিটাল থেকে ফিরছ, আমার মনে আনন্দটানা আঠ দিন বাদে বাড়ি ফিরছ তুমিটেবিলে রেখেছিলাম পদ্ম পোরসলিনের বাটিতেরাতের মেনুতে তোমার পছন্দের খাবাররেশমের চাদরে ঢেকেছে নরম গদিতুমি এলে মুখ থমথমে শার্টের বোতাম ছেঁড়াসমস্ত ঘটনা শোনার পর কি বলব আমি বুঝতে পারি নিচরম রাগে ভেঙে ফেলেছিলাম পোরসলিনের বাটিতুমি স্বাভাবিক স্বরে বলেছিলে-‘ এত রাগ কর কেন? ওদের কি দোষ ওরা তো সাধারণ মানুষবেঁচে থাকার লড়াইটা যে বড্ড কঠিন।'  কথা তুমি বলতে পারোচিরকাল অন্যের কথাই ভেবে গেলে কিন্তু ওরা ভাবে নি তোমার কথাযে হাউসিং - এত দিনের বাসতারাই বেঁকে বসলতারা ঢুকতে দেবে না তোমাকেতোমার থেকেই নাকি ছড়াতে পারে সংক্রামণতাই তুমি নিলে স্বেচ্ছায় নির্বাসনআমি জানি এটা স্বেচ্ছায় নয়, এটা বাধ্য হয়েআমি চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে ছিলামমনে হল যে মানুষরা আক্রমন করল তোমায় তারা কি দেখল না তোমার ডাক্তারে পরিচয়ের পিছনে একটা মানুষের শরীর আছেযেটা তাদের বহু পরিচিতবিগত দিনের কোন স্মৃতিই কি তাদের চোখে ধরা পড়ে নি? বিষন্নতায় নিজের নখ উপরে আসে হাতে উত্তর পাই না

 সেদিন হঠাৎ করে কি বৃষ্টি শুরু হলআচ্ছা ওই বৃষ্টি কি তুমি পাঠিয়েছিলসেই কি আমার মেঘদূতআমি বৃষ্টিতে ভিজি চোখের জল গুলো লুকিয়ে যায় সহজেইআমি জানি তুমি রাগ করেছতোমার এত বছরের জীবিকা জীবন ধারণ সব কিছু তোমার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছেতুমি বলেছিলে –‘ শ্রীতমা আমি মৃত্যুকে ভয় পাইআমি আর দেখতে পারছি না মৃত্যুগোটা পৃথিবী জুড়ে যেন লাশের মেলা বসেছেআমার গা গুলিয়ে উঠছে আর আমি নিরুপায় ডাক্তার।'  ভুল কথা, তুমি ধন্বন্তরি। আমি তোমাকে দেখেছি রোগীর মৃতদেহের সামনে যখন পরিবারের কান্না তুমি ঘুষি মেরেছ করিডোরের দেওয়ালেতোমার বিনিদ্র রাতের সাক্ষী আমিতুমি মৃত্যু দেখেছ কিন্তু তার পাশে বসে থাকা অন্য এক বাবাকে দেখ নি যে তখনও বিশ্বাস করে ডাক্তার মানে দেবতাতুমি হাহাকার শুনেছ নবজাতকের কান্না শোনো নিতুমি যে কান্ডারি অরিন্দম তুমি ফিরে এসো , ফিরে এসো তোমার সাধের হসপিটালে, তোমার রোগীদের কাছে, তোমার ঘরেএকদিন তোমায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি কে তোমার? তুমি বলেছিলে-‘ আমার ঘুম ভাঙানিয়াজীবনের কাছে ফিরে এসো অরিন্দম  ফিরে এসো ভালোবাসার কাছে হাজার ঝড়ে হাজার বন্যায় বা খরায় পুড়ে গিয়েও ভেসে গিয়েও সে আজও মাথা তুলে দাঁড়ায়সে আজও প্রেমের রাখি বোনে সেই রাখি নিজের হাতে বেঁধে নাও অরিন্দম আর হয়ে ওঠ মৃত্যুঞ্জয় কারণ প্রেমই পারে ধ্বংসের মধ্যে সৃষ্টির বীজ বুনতেপ্রেমই পারে মৃত্যুকে জয় করে নীলকন্ঠ হতে

 ইতি,

 অপেক্ষারত তোমার

 ঘুম ভাঙানিয়া

 



ছবি : সংগৃহীত