পরম প্রিয় অরিন্দম,
চারপাশে একটা দম বন্ধ করা পরিস্থিতি। মনে হচ্ছে অদৃষ্ট যেন কালো কাপড়ে ঢেকে দিয়েছে সবকিছু। মনে হচ্ছে কেউ যেন অন্ধকার একটা ঘরে আটকে রেখেছে। কোনো দিকে যাওয়ার জো নেই তবুও আমি তোমায় চিঠি লিখছি। একটা ঠিকানাহীন চিঠি।
অরিন্দম এমন কেন করলে? কেন নিজেকে আড়ালে রাখছ? কেন নিলে স্বেচ্ছায় নির্বাসন? কেন কিছু বলো নি আমায়? যদিও তুমি কিছুই বল নি কোনোদিন কখনও। তুমি বলেছ –‘ বলার কি আছে?’ বলার কি কিছুই থাকে না। প্রকাশ শব্দ তোমার অভিধানে নেই। কিন্তু কত বোঝা যায় বলতো। এই কানগুলো শুনতে চায় কথা। তবে কিছু যে বল নি তা নয়, বলেছ। যেদিন আনত মুখে তোমার জন্য অপেক্ষায় , ঘরের দরজা ঠেলে বলেছিলে ‘কাছে এস’। আমার কানে যেন সহস্র শব্দ তীরের বেগে খেলে গিয়েছিল। চোখের সামনে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল। সেই স্মৃতি আজও হলুদ হয় নি। কিন্তু একি হলো তোমার? নির্বাসনে যদি যেতেই হয় আমিও যাবো। শ্রীরামচন্দ্র কি একা গেছিলেন সীতা মা ও তো সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু তুমি বললে-‘ না শ্রীতমা আমাকে একাই যেতে হবে।' আমি যাই নি। আমি ঘরে একাকী। ভোরবেলায় এক কাপ চা নিয়ে বসি আমার বারান্দায়। তুমি ভাবছ এখনও সকালে ওঠার কি আছে? আগে উঠতাম তোমার ডিউটির জন্য, এখন অভ্যেস। মানুষ যে অভ্যেসের দাস। চা খেতে খেতে আমার চার বাই ছয়ের বারান্দায় ঘুরপাক খাই।গাছে জল দিই। দশটা বাজে রান্না বসাই চাল ডাল আলু সেদ্ধ হয়। প্রেসারে সিটি পরে আমার মনে পড়ে আমাদের প্রথম দেখা হওয়া। এক সরস্বতী পুজোয় বইমেলার নাম করে তোমার সাথে কাটানো পড়ন্ত বিকেল। কিংবা সোনাঝুড়ির মাঠে কোনো এক দোলে দুজনের হারিয়ে যাওয়া আবিরের রঙে। সেই রঙের প্রতিটি সোহাগ লেগে আছে নীল ডুরে শাড়ীতে। সেই শাড়ী এখন আলমারির তাকে কাঁদছে।
আমার মনে আছে যেদিন তুমি হসপিটাল থেকে ফিরছ, আমার মনে আনন্দ। টানা আঠ দিন বাদে বাড়ি ফিরছ তুমি। টেবিলে রেখেছিলাম পদ্ম পোরসলিনের বাটিতে। রাতের মেনুতে তোমার পছন্দের খাবার।রেশমের চাদরে ঢেকেছে নরম গদি। তুমি এলে মুখ থমথমে শার্টের বোতাম ছেঁড়া।
সমস্ত ঘটনা শোনার পর কি বলব আমি বুঝতে পারি নি। চরম রাগে ভেঙে ফেলেছিলাম পোরসলিনের বাটি।তুমি স্বাভাবিক স্বরে বলেছিলে-‘ এত রাগ কর কেন? ওদের কি দোষ ওরা তো সাধারণ মানুষ। বেঁচে থাকার লড়াইটা যে বড্ড কঠিন।' এ কথা তুমি বলতে পারো। চিরকাল অন্যের কথাই ভেবে গেলে। কিন্তু ওরা ভাবে নি তোমার কথা। যে হাউসিং -এ এত দিনের বাস। তারাই বেঁকে বসল। তারা ঢুকতে দেবে না তোমাকে। তোমার থেকেই নাকি ছড়াতে পারে সংক্রামণ। তাই তুমি নিলে স্বেচ্ছায় নির্বাসন।আমি জানি এটা স্বেচ্ছায় নয়, এটা বাধ্য হয়ে। আমি চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে ছিলাম। মনে হল যে মানুষরা আক্রমন করল তোমায় তারা কি দেখল না তোমার ডাক্তারে পরিচয়ের পিছনে একটা মানুষের শরীর আছে। যেটা তাদের বহু পরিচিত। বিগত দিনের কোন স্মৃতিই কি তাদের চোখে ধরা পড়ে নি? বিষন্নতায় নিজের নখ উপরে আসে হাতে উত্তর পাই না।
ইতি,
অপেক্ষারত তোমার
ঘুম ভাঙানিয়া
ছবি : সংগৃহীত