সন্ধ্যে হতে বৃষ্টিটা বেশ ধরেছে। সীমা কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে এলো। আজ রাতে এখানেই থাকবে। কারণ আজ মায়ের জন্মদিন। ব্যাগ থেকে চাবি বের করে নিজেই দরজা খুলল। যা আগে কোনোদিনই করতে হয়নি কারণ মা ছিল। আর যখন মা বেরত, আরতি মাসি থাকত। তবে এখন গোটা ফ্ল্যাটই শূন্য। সীমা মায়ের ছবির সামনে রাখা ফুলদানিতে রজনীগন্ধা রাখতে রাখতে ভাবলো মা বলত – ‘কাজ করে যাও, একটা সময় দেখবে ওই কাজগুলোই থেকে যাবে।' আর সেই জন্যই ‘আলোর ঘর’-এর আলো এখনো নেভেনি। সীমা ছয় বছর বয়সে সুপর্ণা দেবীর সাথে এই বাড়িতে এসেছিল, ওদের পরিচয় আলোর ঘরে। সেখানে অতগুলো অনাথ শিশুর মধ্যে সীমার প্রতি আলাদা টান অনুভব করেছিলেন সুপর্ণা দেবী। তাই সিদ্বান্ত নিয়ে ছিলেন সারাজীবন সীমাকে নিজের কাছে রাখবেন। প্রথমদিনেই মা বলে দিয়েছিল এই বাড়িতে শুধু আমরা দুজনেই থাকব। তাই বাবার কথা জানার সাহস হয়নি সীমার তবে কৌতূহল থেকে গেছে। আসলে তিনি খুব রাশভারী ছিলেন। নিজের দায়িত্বে খুলেছিলেন ‘ আলোর ঘর’। মা মারা যাওয়ার পর প্রায় ছয় বছর হল সীমাই সামলাচ্ছে এই আশ্রম। আশ্রমের পুরোনো কিছু ফাইল মায়ের আলমারিতে আছে। সীমা আলমারি খুলল নাকে এলো ন্যাপথলিনের গন্ধ। প্রতিটা তাকে যত্ন করে রাখা শাড়িগুলো যেন এক একটা গল্প। কত কিছু মনে পড়ছে ওর। আলমারিটা দেখে মনেই হচ্ছে না যে মানুষটা এত বছর নেই। প্রতিবেশী আত্মীয়রা বলেছিল মৃত মানুষের জিনিস ঘরে রাখতে নেই। তবে সীমা সে সবে কান দেয়নি। আর দেবেই বা কেন কার মেয়ে দেখতে হবে তো। একটা তাকে সীমার ছোটবেলার সব জামা। এতদিন হয়ে গেছে স্কুল ড্রেসটা পর্যন্ত গুছিয়ে রাখা। সবুজ আর লালের সেই শাড়িটা দেখে ওর মনে পড়ল হাত খরচ আর টিউশন পড়ানো টাকায় একবার পুজোয় এই শাড়িটা মার জন্য কিনেছিল। পরে আরতি মাসির থেকে শুনেছিল সবুজ রংটা মার একদম পছন্দ নয়। কিন্তু মা ওই শাড়িটা পেয়ে এত খুশি হয়েছিল যে বলার কথা না। সীমা শাড়িটা হাতে নিল কেমন একটা গন্ধ, গন্ধটা মার গায়ের। ডানদিকের ওই নীল শাড়িটা দেখে ওর মনে পড়ল এই শাড়িটা পরে প্রথম আদির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। মা ছিল একমাত্র বন্ধু ।তাই আদির কথা সুপর্ণা দেবীকে খুব সহজেই বলতে পেরেছিল ও।
সীমার বিয়ের সময়ে একটা ঝামেলা হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই ছেলের বাড়ি থেকে প্রশ্ন উঠেছিল- কে কন্যাদান করবে? পরোক্ষ ভাবে পিতৃ পরিচয় প্রসঙ্গ উঠেছিল। সুপর্ণা দেবী ঠান্ডা মাথায় সব সমস্যার সমাধান করেছিলেন। আদি-র বাড়ির সবাইকে রাজি করিয়ে ছিলেন যাতে কন্যাদান বিষয়টা বাদ দেওয়া যায়। যদিও বিষয়টা এত সহজ ছিল না। বিয়ে বাড়িতে অনেকেই ওই নিয়ে কানাঘুষো কথা বলেছিল। সে যাই হোক ভালো কাজে সমালোচনা হবে না তাই আবার হয় নাকি তবে তিনি একাই সামলেছেন সবটা। সুপর্ণা দেবী এমন মানুষ ছিলেন যিনি সব বাধাকে অতিক্রম করার সাহস রাখতেন। ফাইল পত্র বের করতে গিয়ে সীমা দেখল সেই কালো স্যুটকেসটা যেটা মা কোনো দিনও ধরতে দেয় নি। আর ছোটবেলার মতো সীমার আজও ওই ব্যাগটার প্রতি কৌতূহলের শেষ নেই। তাই বেশ কিছুটা দ্বিধা কাটিয়ে সীমা ব্যাগ খুলল। দেখল লাল বেনারসি শাখা পলা আর একটা ডায়েরি। ডায়েরির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সীমা বুঝল মা কতটা একা ছিল। তাই ভালো লাগা খারাপ লাগার মুহূর্ত গুলো ডাইরি বন্দি করত। শারীরিক অক্ষমতা না থাকা সত্বেও সন্তান দত্তক নিতে চেয়েছিলেন সুপর্ণা দেবী। কিন্তু শ্বশুর বাড়ির কেউ মেনে নেবে না, পরিচয়হীন কাউকে তারা বংশধর হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি নন। আর এক্ষেত্রে নিজের স্বামীকে পাশে না পাওয়ার দুঃখটা তাকে বেশি কষ্ট দিয়েছিল। ডায়েরিতে লেখা –‘ দিন দিন ওর সাথে দূরত্ব বাড়ছে । দুজনের মধ্যে যেন একটা অদৃশ্য পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। যা অতিক্রম করার সাধ্য আমার নেই। যদিও এই পাহাড় সৃষ্টির দায় কিছুটা আমারও। বেশ বুঝতে পারছি এ বাড়িতে আমার অস্তিত্ব অন্যদের পক্ষে বেশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। তাই ঠিক করলাম বাবার কাছেই বাকি জীবনটা থাকব। অহেতুক সম্পর্ককে টেনে নিয়ে চলার মধ্যেই কোন ছন্দ থাকে না। আর ছন্দ ছাড়া জীবন চলে না অন্তত আমার কাছে। এই সিদ্বান্ত একান্ত আমার’। সীমা দেখল মায়েরলেখা –‘ আজ আলোর ঘর দু বছরে পা দিল। বাবা, তুমি থাকলে খুব খুশি হতে। জানো বাবা আজ বছর ছয়ের একটা মেয়ে এসেছে আমাদের কাছে। ওর চোখদুটি কি মায়াময়। আমি এ কদিন ঘুমোতে পারি নি। ওই মেয়েকে আশ্রমে ছেড়ে আসতে মন চায় না। তাই ঠিক করলাম ও আমার কাছে মেয়ে হয়ে থাকবে সারাজীবন’। সীমার দু গাল বেয়ে জলের ধারা ডায়েরির পাতাকে ভিজিয়ে দিল। টুকরো টুকরো কত ছবি- কোনটায় সীমা মাকে জন্মদিনে কেক খওয়াছে কোনটায় প্রথম স্কুলে যাওয়া মা র হাত ধরে । এসব দেখতে দেখতে কখন যে রাত হয়েছে খেয়ালই ছিল না। আদি ফোন করে তাড়া দেওয়ায় ভাত বসলো সীমা। ভাবল মা থাকলে এটা ওটা সেট কত কি রান্না করত। কোনোদিন আমার প্রতি কোনো অযত্ন করেন নি মা।
এরমধ্যেই আশ্রম থেকে ফোন এল। আলোর ঘরে এতদিন অনাথ শিশুরা থাকত। দু বছর ধরে বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে ঠিকানা দিতে পেরেছে এই আশ্রম। সীমা জানতে পারল কিছুক্ষন আগে পুলিশ এসে সহায় সম্বলহীন একজন বৃদ্ধকে আশ্রমে ছেড়ে গেছেন। সকাল হতেই সীমা আশ্রমে গেল,রেজিস্টারে বৃদ্ধর নাম ঠিকানা দেখে ওর সব কিছু গুলিয়ে গেল।মনে পড়ল মার ওই ব্যাগে বিয়ের কার্ডে পাত্র পরিচয়ে এই নামটাই ছিল। সীমা অম্লানবাবুর সাথে দেখা করল। জানতে পারল তার দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেমেয়ে তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। তাই আজ তিনি ঠিকানাহীন ও পরিচয়হীন। কথা বলতে বলতে অম্লানবাবু চোখ জলে ঝাপসা হয়ে গেছে তবু তিনি সীমাকে লক্ষ্য করলেন। ছিপছিপে চেহারা পরিপাটি করে শাড়ি পরা বাম দিকে সিঁথি করে খোঁপা বাধা। এ যেন খুব চেনা মানুষের প্রতিচ্ছবি। জলের গ্লাসটা রাখতে গিয়ে টেবিলে রাখা ফ্রেমের দিকে চোখ গেল ওনার। তিনি ফ্রেমটা হাতে নিলেন।সীমা বলল –‘ এটা দোল উৎসবে তোলা । ওই দিনই আমি এখানে প্রথম আসি। তার পর থেকেই মায়ের কাছে থাকা। আজ থেকে আপনার পরিচয় বাবা। এই আশ্রমে সকল বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে আমরা ‘বাবা’ ও ‘মা’ বলেই সম্মোধন করি। আর সকলের একটাই ঠিকানা আলোর ঘর’। অম্লানবাবু দেখলেন অফিসরুমের দেওয়ালে সুপর্ণা দেবীর একটা বড় ছবি আর সামনে প্রদীপ। তিনি এগিয়ে গেলেন হাত জোড় করে অঝোর নয়নে চেয়ে রইলেন ছবির দিকে। আশ্রমের বারান্দা থেকে ভেসে আসছে প্রার্থনা সংগীত
‘ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা
যা কিছু পায় হারায়ে যায় , না মানে সান্ত্বনা....'
ছবি:
সংগৃহীত
Poriskar jhor jhore lekha...bhalo laglo
ReplyDeleteএত বছর পর উত্তর দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত।
Deleteধন্যবাদ ।