19.11.21

ভিড়ের মাঝে একলা হওয়া

বেড়াতে যাওয়া মানেই চোখ বন্ধ করে কদিনের জন্য রোজকারের জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া। সেই রকম ইচ্ছে করল আমাদের। আমাদের মানে , আমি আর আমার কর্তা । কিন্তু কোথায় যাবো? মনের সব প্রশ্নের উত্তর দিল গুগুল। একটা ক্লিক আর কৌতূহলের সমাপন। ঠিক হল বেনারস। সময়টা ছিল নভেম্বর মাস, শীতের চাদর জড়িয়ে চেনা শহরকে বিদায় দিয়ে ট্রেন স্টেশন ছাড়ল। মানুষ যেখানে যায় সেখানেই নিজের মতো একটা সংসার বানিয়ে নেয়। কামরায় ঢুকতেই দেখি দুজন মারওয়ারী মহিলা প্রাতরাশ সারছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে বাংলা হিন্দি মিলে গেল। সবুজ মাঠ পেরিয়ে, খাল পেরিয়ে ট্রেন ছুটছে সাঁ সাঁ। শহুরে কোলাহল ডুব দিয়েছে ট্রেনের ঘর্ ঘর্ শব্দে। ছোট্ট জানলার ক্যানভাসে ধরা পড়ছে নানা ছবি। সবুজ ধানক্ষেতের রং ক্রমশ হালকা সবুজ,হলুদ হয়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও সবুজের মধ্যেই লালের পারদ বেশি চড়িয়ে বাদামি তার জায়গা করে নিয়েছে । মালভুমিগুলো জানান দেয় গৃহ রাজ্যটি থেকে বিদায় নিয়েছি আমরা। সূর্যদেব গুটিগুটি পায়ে হাঁটছেন,বেলা বাড়ছে। ট্রেনে বসে সূর্যাস্ত দেখতে অপূর্ব লাগছিল । ধীরে ধীরে আমাদের গন্তব্য এসে হাজির। ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম তখন প্রায় আটটা বাজে। হোটেলে যেহেতু বলা ছিল তাই অল্প সময়ের মধ্যেই টোটো এসে গেছিল। গাড়িতে যেতে যেতে অচেনা শহরের ভূমিকা পেলাম। চারপাশে শপিংমল,বিদেশি ব্রান্ডের দোকান, সিগন্যালে বিরক্তি সবকিছু পেরিয়ে টোটো চক্ নামক জায়গায় এসে দাঁড়াল। সেখান থেকে মিনিট দশেক হাঁটা তারপরই হোটেল অলকা। হাঁটতে হবে কেননা রাস্তা গলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে কোনোরকমে হোটেলে পরিচয় পর্ব সেরে রুমে গেলাম । তারপর সাময়িক ফ্রেশ হয়ে খিদের তাড়নায় নীচে আসা।
এই হোটেলের বিশেষ আকর্ষণ হল গঙ্গার ঘাট। আসলে হোটেলটি একেবারে ঘাট লাগোয়া। এর খাবার জায়গাটা খুব মনোরম,কিছুটা ছাদ খোলা জায়গায় চেয়ার টেবিল পাতা আবার ভিতরেও বসে খাবার ব্যবস্থা আছে। তবে আমরা উদাত্ত গঙ্গাকে দেখতে দেখতে তারা ভরা আকাশের নিচে রাতের খাবার সারলাম। ঐ সময়টা ছিল ছট্ পুজোর আগের দিন। তাই কত মানুষ রাত থাকতেই ঘাটে এসে হাজির হয়েছে পরে দিনের পুজোর জন্য । নতুন সকাল যেন নিজে দুহাত দিয়ে চোখ খুলে দিল। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম মা গঙ্গার বুকে সূর্যের আলো যেন লক্ষ লক্ষ হীরে হয়ে ঝলমল করছে। নদীবক্ষে ভেসে চলছে অজস্র নৌকা। ভোরের বেনারস যেন স্বপ্নের মত যেমন শান্ত তেমনি নরম। বিচিত্র সব ছবি কেউ সুর্য প্রণাম সারছে আবার কেউ হয়তো চায়ের পেয়ালায়ে শেষ চুমুক দিচ্ছে। গাইডরা পর্যটকদের নিয়ে বেরিয়ে পরেছে। কথিত আছে মহাদেবের নগরী এই বেনারস। শহর জুড়ে রয়েছে মন্দির,তার মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ হল কাশী বিশ্বনাথের মন্দির। সভ্যতা সংস্কৃতির পীঠস্থান হল এই বেনারস। গঙ্গার দুই উপনদী বরুণা ও অসি দুয়ে মিলে বারাণসী। এই শহরের নামকরণ নিয়ে লোকমুখে রয়েছে আরও কাহিনী। অনেকের মতে ভারতের তীর্থস্থান গুলির মধ্যে অন্যতম পুণ্যভূমি হল এই বেনারস। এছাড়া ভক্তি আন্দোলনের রেশও এই ভূমিতে পাওয়া যায়।
আমার মনে হয় ঘুরতে এসে যদি পায়ে হেঁটে এলোমেলো না ঘুরলাম ,তাহলে কোনো মজাই নেই। তাই বেরিয়ে পড়লাম গাইডবিহীন ভ্রমণে  এই শহরের অলিগলি যত ঘুরছি ততই মনে হচ্ছে যেন ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠচ্ছে। রাস্তার দুধারে সারি দিয়ে দোকান। কোথাও গনগনে আগুনে দুধ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। আবার কোথাও ছাঁকা তেলে ফুলে উঠছে কচুরি। কোথাও বিদেশীদের ক্যামেরায় ধরা পড়ছে দেশীয় সাধুবাবার বিভিন্ন ছবি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা শিব পার্বতী সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘাটের পাশে রয়েছে দোকান পুজোর সামগ্রী, হার কানের দুল টুকিটাকি জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে। আবার অনেক নৌকায়ও এসব বিক্রি হচ্ছে। এইসব দেখতে দেখতে দুপুর কখন যে সদ্য বিকেলকে ছুঁয়েছে খেয়াল করিনি। চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘাট ভ্রমণে। যাত্রা শুরু হল মীর ঘাট থেকে। তারপর দশশ্বমেধ, ললিত,অহল্যাবাই,রাজা হরিশ্চন্দ্র,অসি ঘাট আরও কত। এক একটা ঘাট যেন ছবির মতো। ক্লান্ত পা কে আরাম দিতে নৌকা ভ্রমণ আবশ্যক। নৌকায় যেতে যেতে মনে হল ঘাট গুলো যেন চলচ্ছবি। নৌকায় বসে সূর্যাস্ত দেখলাম, সে অনুভূতি লেখায় প্রকাশ করা যাবে না। এর মধ্যেই দশশ্বমেধ ঘাটে সন্ধ্যা আরতি শুরু হয়েছে। ধূপ ধূনা আর ঘন্টা ধ্বনিতে মুখরিত ঘাট চত্বর। কত মানুষ ভিড় করেন এই আরতি দেখার জন্য। পিতলের ধূনচি,প্রদীপ,কর্পূরদানি প্রত্যেক দিন ব্যবহৃত হয়।
ধীরে ধীরে নৌকা ভিড়ল মনিকর্নিকা নামক ঘাটে,সেখানেও আগুন জ্বলছিল। তবে সেটা ছিল চিতার আগুন। মাঝির মুখে শুনলাম এই ঘাটে মৃতদেহ দাহ করা খুব পুণ্যের। এই ঘাটে মৃতদেহ দাহ করলে নাকি মুক্তি প্রাপ্ত হওয়া যায়। আরও বললেন যে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে দেবী পার্বতীর কুন্ডল এখানে হারিয়ে গেছিল। অনেক খোঁজার পরও পাওয়া না যাওয়ায় মহাদেব প্রচন্ড রেগে সমুচী জাতিকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে তারা মৃতের মুখে অগ্নিদান করবে। সেই থেকে এই জাতি ডোম জাতি নামে পরিচিত। একটা ঘাটে পূজা অর্চনা আর অপর ঘাটে জীবনে চরম সত্যের মুখোমুখি। নৌকায় বসে চিতার ওই আগুন দেখছিলাম। আর মনে হচ্ছিল এই আগুনে মানুষের সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অথচ জীবিত থাকাকালীন আমরা আমাদের আমিত্বটুকু পোড়াতে পারি না। সারা শরীরে কেমন নিস্তব্ধতা বাসা বেঁধে ছিল।
নদীতে অবসন্নতাকে ভাসিয়ে দিয়ে হোটেলে ফিরেছিলাম। পরের দিন সকালটা একটু অন্যভাবে হয়েছিল। ঘুম ভাঙল তবলার আওয়াজে, হোটেলের লাগোয়া বাড়ি থেকে ওই সুর আসছে। সাত সুরের লহমায় সকাল ভরে উঠল। বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম একজন জাপানি মহিলা ছবি আঁকছেন। কাছে গিয়ে দেখলাম তিনি একজন বয়স্ক লোকের ছবি আঁকছেন। তার টেবিলে রং তুলি। ওয়েটার এসে কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করায় তিনি এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। আসলে ভাষা যে কোন বাধা হতেই পারে না তা আবার প্রমাণিত হল। বেনারসে এসে পান খায় নি এমন মানুষ বোধহয় নেই। চক্ এর কাছে একটি মসজিদ আছে তার ঠিক পাশেই আছে বেনারসী পানের দোকান। দোকানে থাকা লোকটির মুখ থেকে জানতে পারলাম এই দোকানটি তার প্রায় তিন পুরুষের। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই এই দোকানের জন্ম।পরাধীন ভারতে বেশ কিছু পত্রিকা ইংরেজ সরকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল।শোনা যায় তখন এই বেনারসি পান কাগজে মুড়ে এবং তাতে কাগজ পুড়ে বাড়ি বাড়ি বিতরণ করা হত। ভ্রমণের সাথে ভোজন কথাটিকে অগ্রাহ্য করলে মোটেও চলে না। একটা বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় ঘাটের ধারে যে হোটেল বা লজ আছে তাতে নিরামিষ রান্নাই বেশি পাওয়া যায়।তবে একটু দূরে আমিষ রান্নাও আছে। তবে আমার মূল আকর্ষণ ছিল রাস্তার ধারের খাবার গুলো।পুরি সব্জী সাথে জিলিপি আর লস্যির স্বাদ তো ভোলার নয়। তবে একটা নতুন জিনিস খেয়েছিলাম তা হলো নিমিস।দুধের ফেনা দিয়ে তৈরি এক জিনিস।শুধু যে ফেনা তা নয় তবে বেশি কিছু বোঝার আগেই মন এত তৃপ্ত হয়েছিল যে আর উপকরণ খুঁজি নি।
বেনারসের থেকে কিছু দূরত্বে রয়েছে বেনারস ইউনিভার্সিটি ও রামনগর দুর্গ। ১৭৫০ সালে রাজা বলবন্ত সিং মুঘল আদলে তৈরি করেন এই রামনগর দুর্গ। গঙ্গার পূর্ব তীরে তুলসী ঘাটের কাছে এটি অবস্থিত।আমরা যেদিন গেছিলাম সেদিন এই দুর্গে শুটিং চলছিল তাই বেশ কিছু জায়গায় যাওয়া নিষেধ ছিল। তবে এই দুর্গের ভিতর একটি সংগ্রহশালা আছে। আমরা টিকিট কেটে ঢুকে পড়েছিলাম সেখানে।কত ধরনের পালকি দেশী বিদেশী গাড়ি চোখে পড়ল। এছাড়াও আছে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ধরণের তলোয়ার বন্দুক বর্শা। সব মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক অস্ত্র। সোনা রূপায় সুতোয় বোনা রাজা মহারাজদের পোশাক, চাদর। চোখের সামনে রাজকীয় পরিবেশ পরখ করেছিলাম। এ ঘর ও ঘর ঘুরতে ঘুরতে প্রায় বিকেল হয়ে গেছিল। সন্ধেকে কাধেঁ নিয়ে হোটেলে ফিরেছিলাম।



দেখতে দেখতে ছুটিও শেষ এবার ফেরার পালা  বেনারসে কাছে পিঠে অনেক ঘোরার জায়গা থাকলেও আমার মূল আকর্ষণ ছিল ঘাটগুলো। মানুষের জীবনযাত্রার সাথে ঐ ঘাট গুলো কিভাবে জড়িয়ে গেছে তাই লক্ষ্য করছিলাম  নভেম্বরের মাঝামাঝি দেবদীপাবলি অনুষ্ঠান হয়। তাতে এই সমস্ত ঘাট গুলো সেজে ওঠে লক্ষ লক্ষ প্রদীপে। দেশ বিদেশে থেকে মানুষ আসে তা দেখতে। আমাদের হাতে সময় না থাকায় এই আক্ষেপ রয়ে গেল। নৌকা গুলো নতুন রঙে সেজে উঠেছে। চারপাশে একটা উৎসবের আমেজ।
আপাত ভাবে দেখলে বেনারস বা কাশী খুবই জনবহুল একটি জায়গা। কিন্তু এই শহরের গলিগুলো, চলটা ওঠা পুরোনো বাড়ি, দোকানে ঝোলানো বিক্রি না হওয়া বেনারসী শাড়ি, রাতে নিভে আসা আলোয় নির্জন ঘাট এসব দেখলে ভিড়ের মাঝে একলা হতে ইচ্ছে করে । এখন প্রায় বছর তিনেক হল বেনারস ভ্রমণের। আজও রোজকার ব্যস্ততা মনখারাপের চাপান উতরে যখন একা লাগে তখন মনে পড়ে ওই ঘাটে বাধা নৌকাটার কথা। জলের তোড়ে দুলে উঠলেও বাঁধন ছিঁড়তে পারে না মাঝির অপেক্ষায় থাকতে হয়। অনেকটা আমাদের মতোই তাই না ?

ছবি : নবারুণ মাইতি 

2 comments:

  1. খুব সুন্দর লেখাটা।বারাণসী ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল।ছবিগুলোও অসাধারণ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।

      Delete