30.6.22
পাহাড়ের বাসাখানি
গত বছর শেষের দিকে পাহাড়ে গেছিলাম সবাই যেমন যায় আর কি। তবে এমন কিছু ভ্রমণ থাকে যা নিজেকে চিনতে সাহায্য করে। বেড়াতে এসে বাইরের প্রকৃতিকে যে এত নিবিড় ভাবে পাব তা কখনো ভাবিনি। তাই এই ব্লগ কোন ট্রাভেল বা হোটেল রিভিউ নয় বরং খানিকটা নিজের অনুভূতির কথা ভাগ করে নেওয়া। আমাদের প্রত্যেকেরই প্রায় দুটো বাসা থাকে। একটা যেখানে আমরা শারীরিক অবসস্থান করি,রোজনামচার জীবন। চালটা তেলটা নুনটা নিয়ে যেখানে রোজ ঝগড়া বাঁধে। সে বাসায় চিল বসে না। কিন্তু আরেকটা হল মনের বাসা,যেখানে শুধুমাত্র নিজে থাকা হয়। চোখ বন্ধ আর খোলার মধ্যে এই বাড়ির গন্ডি। তবে যদি কখনো সেই বাড়িতে থাকার সৌভাগ্য হয় তাহলে তো কথাই নেই। তেমনই এক সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের ।
দার্জিলিং যতটাই জনবহুল মিরিক ততটাই শান্ত। অনেকেই সাইডসিনের তালিকায় রাখেন এই মিরিককে। তবে যারা একান্তে কাটাতে চান তাদের কাছে এ একেবারে স্বর্গ। পাহাড়ে বাড়ি কেনার শখ কার না থাকে? তবে কিনব বললেই তো আর কেনা যায় না সেক্ষেত্রে কয়েকটাদিন নিজের বাড়ি অনুভাবটা অবশ্যই পাবেন কোথায়? মিরিক বাজার থেকে পুলিশ থানার বাঁ দিক দিয়ে রাস্তা নেমে গেছে নিচে পাহাড়ী রাস্তার বাঁকে অভ্যস্ত নাহলেও পাইনের সারি দেখতে দেখতে কখন যে গন্তব্যে এসে পৌঁছবেন খেয়ালই থাকবে না। আমাদেরও ছিল না। গাড়ি একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াতেই হোমস্টেয়ের ম্যানেজার ও তার দুই সঙ্গী এসে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। তাদের সঙ্গে আমরা আরও কয়েক ধাপ নিচে নেমে গেলাম আর যা দেখলাম তা অবর্ণনীয়। হোমস্টেটি একেবারে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত। আকর্ষণীয় বিষয় হল এই হোমস্টেতে অ্যাপার্টমেন্ট অ্যাকোমোডেসানের সুব্যবস্থা রয়েছে যেমন ডেক অ্যাপার্টমেন্ট,টেরেস অ্যাপার্টমেন্ট,ষ্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদি। আমরা ছিলাম ডেক অ্যাপার্টমেন্টে। নিজেদের ঘর দেখবো বলে আমরা যখন তৃষ্ণার্ত চোখ নিয়ে ম্যানেজারের পিছু নিলাম তখন সূর্য পাটে।
পাহাড়ের উপর ঝুলন্ত একটা কাঠের বাড়ি।হ্যাঁ বাড়ি হোটেলের রুম নয়। তার কারণ না হয় ধীরে ধীরে বলি। মূল দরজার পাশে গাছের গুড়িতে যা লেখা তা বাংলায় দাঁড়ায় ‘পাখির গানের বাসা'। দরজা ঠেলে ঢুকতেই রয়েছে বসার ঘর যার একপাশে সোফা আর অন্যদিকে একটা মস্ত ডিভান সাথে টিভিও আছে যদিও পাহাড়ে তা নিষ্প্রয়োজন। বসার ঘরের একদিকে উঁচু প্লাটফর্ম পেরিয়ে রয়েছে অত্যাধুনিক সুবিধা সমেত রান্নাঘর অনেকটা ক্যাফে স্টাইলে যেটি আমার পুরো বাড়ির মধ্যে দ্বিতীয় পচ্ছন্দের জায়গা। প্রথম কোনটা সেটা পরেই বলব। এই হোমস্টের অন্যতম বিষয় যেটি অন্য হোমস্টে থেকে আলাদা করে দেয় তা হল ইন্টেরিয়র। প্রতিটি ঘর ভীষণ সুন্দর ও যত্ন করে সাজানো। বুকশেল্ফে রাখা বই,হলদে ল্যাম্পশেড,ইন্ডোর প্লান্ট,উডেন কোস্টার এসব দেখলে মনে হয় যেন নিজের বাড়িতেই আছি।
আসলে আমরা বেড়াতে গেলও নিজেদের অজান্তেই নিজের বাড়ি ও অভ্যেসগুলো মিস্ করি। আমাদের পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেছিল তাই ফ্রেশ হয়ে এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি এযেন চাঁদের হাট। একদিকে কার্শিয়াং বিপরীতে দার্জিলিং শহর। রাতের অন্ধকারে নাকি পাহাড় দেখা যায় না? আমি তো বেশ বুঝতে পারি তোকে। ঐ ছোট ছোট আলোগুলো দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন হাজার হাজার হীরে ঢেলে দিয়েছে। আর ওদিকে ঝকঝকে আকাশে তারাদের বৃষ্টি যদিও খালি চোখে তা বোঝা যায় না। ফটোগ্রাফির ভাষায় যাকে বলে star trail।
এই পাহাড়ী বাসখানিই আমাদের আগামী তিনদিনের বসবাস।আগেই বলেছি মানুষ যেখানে যায় সেখানেই তার সংসার নিয়ে যায়।আসল কথা হল নিজের অভ্যেস কাঁধে নিয়ে ঘোরে।আমিও স্বভাব মতোই মসলাপাতির একটা বাক্স নিয়ে গেছিলাম। এত গোছানো রান্নাঘরে রান্না হবে না তা কখনো হয়। বেড়াতে গিয়ে রান্না? অনেকেই ভাবতে পারেন এ আবার কি? ভাবুন তো সকালে যখন সামনের পাহাড়টা আপনাকে সুপ্রভাত বলবে আপনি তখন নিজের বানানো জলখাবার খাচ্ছেন। ভাব যায় ? আসলে একসময়ে মনে হয় চারদিকে ছোটাছুটি করা, সাইডসিনের পিছনে দৌড়ানো,ফোটোর জন্য ভাল লোকেশন খোঁজা এসব ছেড়ে শান্ত হয়ে কোথাও বসি। চুপ করে চেয়ে থাকি পাহাড়টার দিকে। কতদিনের না বলা সব কথা কত কান্না কত হাসি কত বিস্ময় সব যেন এমনি এমনি বেরিয়ে আসে। পাহাড়ের এই বিশালতার কাছে আত্মসমর্পণের মধ্যে কোন কুন্ঠা নেই। তাই আপন খেয়ালে চোখের কোণে জল জমে। এ জল কি দুঃখের না আনন্দের?মন বলে বিস্ময়ের!
হোমস্টের চারপাশে জঙ্গল। ঐ জঙ্গল বেয়ে প্রায় দেড়ঘণ্টা ট্রেক করলে একটা নামহীন ঝর্ণার দেখা মেলে। সত্যি বলতে এই ঝর্ণার আলাদা কোন বিশেষ্বত্ব নেই। তবে ঐ রাস্তাটা ভীষণ মায়াবী। পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার পথ।আর লম্বা লম্বা বাঁশগাছের পাহারা ভেদ করে সূর্যের আলো খুব কমই ঢোকে তাই কেমন ঠান্ডাভাব। সেই পথের সঙ্গী ছিল ব্রুনো (আমার বন্ধুর দেওয়া নাম)এক লমোস পাহাড়ি কুকুর। আমরা যে কদিন ছিলাম ও আমাদের সাথেই ছিল। এই হোমস্টের একটা জিনিস আমায় খুব অবাক করে তা হল অকৃত্রিমতা। পুরো হোমস্টেটি গাছপালায় ঘেরা,কিছু গাছের বয়েস বেশ পুরোনো আবার কেউ সদ্য জন্মেছে। চাইলেই ওনার অন্যভাবে সাজাতে পারতেন যেমন সুদৃশ্য বাগান যেখানে সব গাছের গোড়াগুলোকে এক রঙ করা হয়ে থাকে কিংবা দামী পাথর দিয়ে ঘেরা ফোয়ারা ইত্যাদি। কিন্তু তা হয়নি মজার বিষয় হল যেখানে যে গাছ বেড়ে উঠেছে তাকে সেখানেই বাড়তে দেওয়া হয়েছে। শুধু বাণিজ্যের স্বার্থে তাকে সুন্দর করে তোলার অহেতুক চেষ্টা করা হয়নি। দামী ও অত্যাধুনিক আসবাব অবশ্যই রয়েছে আসলে পাহাড় ঘেরা জঙ্গলকে বাসায় পরিণত করতে হলে খরচ তো হবেই তবে নান্দীকতা বজায় রেখে। বনে যদি বন্যতাই না থাকল তাহলে আর লাভ কি।
এবার আসি এখানে যে জায়গাটা আমার সবথেকে বেশি ভাল লেগেছে। সেটা এই অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দা যেখান থেকে আমি রোজ চাক্ষুষ করতাম আমার প্রেমিক পাহাড়কে। একবুক আকাশ তাকে আগলে রেখেছে আর যুবতী মেঘেরা মাঝে মাঝে এসে তাকে ঢেকে দিচ্ছে। কত রঙ পাহাড়ের!বেলা বাড়ার সাথে সাথে এক একটা রঙ নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। হোমস্টেয়ের ম্যানেজার মানুষটি খুবই ভালো ছিলেন দায়িত্ব নিয়ে সব বাজার করে দিতেন। আমরাও বেশ মাংসে ভাতে বিরিয়ানিতে জমিয়ে পেটপুজো করতাম। দুপুরগুলো কাটত লেবু বাগানে। এই হোমস্টেতে যারা রান্নাসহ অন্য কাজ করতেন তার সবাই পাশের গ্রামের লোকজন।
একদিন সকালে দেখি এক অল্পবয়সী মেয়ে এসে হাজির ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য। সেদিনই আমার প্রথম বিশুর সাথে আলাপ। ও আমাকে ওর বাড়ির কথা বলত, বলত ওর বরের কথা চার বছরের ছেলের কথা আর খুব হাসত। ও আধা নেপালি আধা হিন্দিতে কথা বলত আর আমিও নেপালিতে এটাকে কি বলে ওটাকে কি বলে প্রশ্ন করে ওকে পাগল করে দিতাম। আমাদের ঐ নির্মল কথপোকথন গুলোর জন্য আজও অপেক্ষা করি।
পাহাড়ে কেমন যেন ঝুপ করে সন্ধে নামে। গোটা হোমস্টেটা আলোয় সেজে উঠত। বন ফায়ারে জলন্ত কাঠের আওয়াজ আর ঝি ঝি পোকার ডাক সঙ্গে বারবিকিউ আর সাথে আমার বেসুর ইউকেলীলি বেজে উঠত চেনা গানের কথায়। দূরে কালোচাদর মুরি দিয়ে পাহাড় হেসে বলত আর কদিন বাকি ফেরার? স্বর্গীয় সুখ চিরন্তন নয়। তাই বিদায় নিতেই হল। মেঘেরাও বুঝেছিল আজ আমাদের ফেরার দিন তাই ভোর থেকেই পাহাড়টাকে জড়িয়ে রেখেছিল। অগত্যা পাহাড়কে দেখা হল না। ফেরার পথই বলে পথ শুরুর গল্প। নাহ্ মন খারাপ হয়নি ফিরতি পথে চা বাগানের অলিগলিতে একটু জিরেয়ে নেওয়া। ওখানে বসে মনে হচ্ছিল যা দেখছি যা অনুবভ করছি যদি সবটুকু লিখে রাখতে পারতাম!এই আফসোস চিরকালীন। এয়ারপোর্টে গাড়ি এসে থামল তারপর ধীরে ধীরে গন্তব্যে এগোনো। সিকিউরিটি চেকইন হয়ে গেছে ফ্লাইটেও বসে পরেছি যেই টেকঅফ হল অমনি আমার চোখ বুজল আর সামনে সেই একরোখা খটখটে পাহাড় যে আমাকে কখনো একা ছাড়ে না। আর তার কোলে উঁকি মারছে আমার একরত্তি পাহাড়ের বাসখানি।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
চোখের সামনে ভেসে উঠলো নীলচে পাহাড়,ভেসে বেড়ানো মেঘ,হাসিমুখেই মানুষগুলো..আর হ্যাঁ তোমার রান্নাঘর ও😀
ReplyDelete