21.12.22

হিমেল হওয়া

উৎসবের বারান্দায় এখন একটা হিমেল বাতাস বইছে। ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলেই একটা ঠান্ডা বাতাস যেন হাত বুলিয়ে যায়। বাড়ির সদর দরজার সামনের গাছ থেকে টুপটাপ পাতা খসে পড়ছে।স্কুলের পরীক্ষার জেরে ছেলে মেয়েদের নাজেহাল অবস্থা। কোথায় আর আমেজ ? সকাল সাড়ে ছটায় কেমিস্ট্রি ক্লাসে যেতে রিমোর একদম ভালো লাগে না। এদিকে ওর দাদা এক ধাপ এগিয়ে। সে নিজে সাইকেল চালিয়ে কোচিং ক্লাসে যায়। কোচিং শুরুর দশ মিনিট আগে আর দশ মিনিট পরের সময়টুকুই ভীষণ দামী। যদিও কয়েক ঘণ্টা পরে স্কুলে দেখা হবে তবুও এই ফুরফুরে হওয়ায় মাথায় সিল্কের স্কার্ফটার ফাঁক থেকে আড় চোখে তাকায় সোফিয়া। সেই তালে হিরো সেজে মাথায় কান ঢাকা টুপিটা টেনে নেয় রাহুল। এইসব ইশারা আর কেউ বোঝে না। বোঝে কেবল হিমেল হওয়া। 

এই হাওয়া সাথে করে নিয়ে আসে শীতের আভাস। প্রত্যেকবার একই ছবি, আলমারির মাথা থেকে ঐ বড় সুট্কেসটা নামনো হবে। তাতে কি আছে? বরং বলা ভালো কি নেই। মায়ের কার্ডিগান,বাবার শিলিগুড়ি থেকে আনা সোয়েটার কিংবা গত বছর পুজোয় রাঙা মামার দেওয়া জীন্সের জ্যাকেট। তাছাড়া আরও কত  কি। বাঙালির যা হয় আর কি মনে ধরে কোনো কিছুই ফেলতে পারে না। সেই পুরোনো বাদরের টুপি , নীল রঙের সোয়েটার , হাতের দস্তানা যা কোনোদিন পরা হবে না তবুও ফেলা যাবে না। বরং ফেলার কথা হলেই তীব্র প্রতিবাদে এগিয়ে আসবে সবাই।‘এগুলো স্মৃতি বুঝলি, এগুলোই থেকে যাবে’ বড়দের এই আশ্বাসবাণী শুনে আপনি অন্য কাজে মন দেবেন। হয়তো প্ল্যান করবেন এক সপ্তাহের পাহাড়ী ভ্রমণের।  ঠিক যাওয়ার দুদিন আগে আপনার বেজায় ঠান্ডা লাগবে আর সব কিছু বাতিল করতে হবে। আর বিমর্ষ সপ্তাহান্তের শেষে কোনো এক আড্ডার রাতে মন ভালো করার দাওয়াই খুঁজবেন। আবার কেউ কেউ  হয়তো জাঁকিয়ে কবে  শীত পরবে  তার দিন গুনবেন।  


 এমনই কোনো হিমেল রবিবারে শীতের জামাকাপড়,লেপ কম্বল সব রোদ্দুরে দেওয়া হয়। ছোটবেলায় এই এক মজার বিষয় ছিল। রোদে দেওয়ার আগে সে গুলো ভালো করে কাচা হতো নাহ্ কোনো ড্রাইওয়াশ নয়। আগের দিন রিঠা ভেজানো হতো পরের দিন মা বাবা মিলে সেগুলো কাচত। কখনো কখনো বাড়ির কাকা পিসি দাদারাও সেই কাজে হাত লাগাতো বেশ একটা হইহই ব্যপার হত। আসলে তখন ছোটো ছোটো ঘটনাগুলো সবার সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে কোনো অস্বতি থাকত না। দিন বদলেছে পুরোনো কথা স্মৃতির অ্যালবামে জমা হয়েছে। এখন মেশিন কাচে আর আমি কাচের পাল্লায় চোখ রেখে দেখি স্মৃতিগুলো কেমন ঘুরতে থাকে। হিমেল হওয়ার কাঁধে ভর করে আমার শহরে ঝুপ করে সন্ধ্যে নামে। কুয়াশা গাঢ় হয়ে হ্যালোজেনের আলোয় বাসা বাধে। ছাতিম ফুলের গন্ধে বাতাস ভরে ওঠে আর রাতগুলো আরও মায়াবী হয়ে যায়। হঠাৎ কবিতার টেবিল কোনো এক বইয়ে তলায় পুরোনো রান্নার ডায়েরি পাওয়া যায়। এ পাতা ও পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখ আটকে যায় কেকের রেসিপিতে। 


 এখন যেমন প্রায় সব অনুষ্ঠানে কেক কাটার প্রচলন হয়েছে আগে তেমনটা ছিল না। তখন কেক আসত বড়দিনে। ২৫শে ডিসেম্বরের আগে কেক খাওয়া মানে মহাপাপ ঠিক যেমন সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাওয়া মানা। সে যাই হোক কেকের কথায় আসা যাক। বড়দিনের সকালে বাবা পাড়ার দোকান থেকে রূপোলি রাংতায় মোড়া কেক আনত। সেই কেক হত হালকা বাদামী রঙের তাতে কাজু কিসমিস আর বেশ কিছুটা টুটিফ্রটি  থাকত। তখন প্লাম কেক কাকে বলে জানতাম না। ছোটবেলায় একবার বাড়িতে কেক বানানোর মহাধুম পড়েছিল। সত্যি বলতে সেই কেকের স্বাদ মনে নেই তবে ভ্যানিলা এসেন্সের গন্ধটা নাকে লেগে আছে। আর রয়ে গেছে একটা বিনিদ্র দুপুরবেলার স্মৃতি। পিঠ সোজা করে ঠায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হত। ওদিকে প্রেসার কুকারে কেক হচ্ছে,কাঁটায় কাঁটায় চল্লিশ মিনিট বেক করতে হবে তা না হলেই মুশকিল। তখন তো ওভেনের অটোকাট ছিল না। তবে আজও এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। এখন অবশ্য প্লাম কেকের বাকি উপকরণ গুলো জানি। বুঝি ময়দা আর চিনির রেশিও অনেকটা দাম্পত্যের মতো। বয়েস বাড়ছে,বাড়ছে হিমেল হাওয়ার প্রতি মায়া। আসলে এই হিমেল  হাওয়া  যে পুরোনো স্মৃতিগুলোকে বড্ড উসকে  দেয়।  দেখতে দেখতে শীত আসে, বছর শেষ হয় ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যায়। আর গুনগুন করে মনে বাজতে থাকে “শুধু যাওয়া আসা ,শুধু স্রোতে ভাসা”।

2 comments:

  1. হিমেল হাওয়ায় ভালোলাগার পরশ

    ReplyDelete
    Replies
    1. লেখাটি ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

      Delete