21.12.22

হিমেল হওয়া

উৎসবের বারান্দায় এখন একটা হিমেল বাতাস বইছে। ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলেই একটা ঠান্ডা বাতাস যেন হাত বুলিয়ে যায়। বাড়ির সদর দরজার সামনের গাছ থেকে টুপটাপ পাতা খসে পড়ছে।স্কুলের পরীক্ষার জেরে ছেলে মেয়েদের নাজেহাল অবস্থা। কোথায় আর আমেজ ? সকাল সাড়ে ছটায় কেমিস্ট্রি ক্লাসে যেতে রিমোর একদম ভালো লাগে না। এদিকে ওর দাদা এক ধাপ এগিয়ে। সে নিজে সাইকেল চালিয়ে কোচিং ক্লাসে যায়। কোচিং শুরুর দশ মিনিট আগে আর দশ মিনিট পরের সময়টুকুই ভীষণ দামী। যদিও কয়েক ঘণ্টা পরে স্কুলে দেখা হবে তবুও এই ফুরফুরে হওয়ায় মাথায় সিল্কের স্কার্ফটার ফাঁক থেকে আড় চোখে তাকায় সোফিয়া। সেই তালে হিরো সেজে মাথায় কান ঢাকা টুপিটা টেনে নেয় রাহুল। এইসব ইশারা আর কেউ বোঝে না। বোঝে কেবল হিমেল হওয়া। 

এই হাওয়া সাথে করে নিয়ে আসে শীতের আভাস। প্রত্যেকবার একই ছবি, আলমারির মাথা থেকে ঐ বড় সুট্কেসটা নামনো হবে। তাতে কি আছে? বরং বলা ভালো কি নেই। মায়ের কার্ডিগান,বাবার শিলিগুড়ি থেকে আনা সোয়েটার কিংবা গত বছর পুজোয় রাঙা মামার দেওয়া জীন্সের জ্যাকেট। তাছাড়া আরও কত  কি। বাঙালির যা হয় আর কি মনে ধরে কোনো কিছুই ফেলতে পারে না। সেই পুরোনো বাদরের টুপি , নীল রঙের সোয়েটার , হাতের দস্তানা যা কোনোদিন পরা হবে না তবুও ফেলা যাবে না। বরং ফেলার কথা হলেই তীব্র প্রতিবাদে এগিয়ে আসবে সবাই।‘এগুলো স্মৃতি বুঝলি, এগুলোই থেকে যাবে’ বড়দের এই আশ্বাসবাণী শুনে আপনি অন্য কাজে মন দেবেন। হয়তো প্ল্যান করবেন এক সপ্তাহের পাহাড়ী ভ্রমণের।  ঠিক যাওয়ার দুদিন আগে আপনার বেজায় ঠান্ডা লাগবে আর সব কিছু বাতিল করতে হবে। আর বিমর্ষ সপ্তাহান্তের শেষে কোনো এক আড্ডার রাতে মন ভালো করার দাওয়াই খুঁজবেন। আবার কেউ কেউ  হয়তো জাঁকিয়ে কবে  শীত পরবে  তার দিন গুনবেন।  


 এমনই কোনো হিমেল রবিবারে শীতের জামাকাপড়,লেপ কম্বল সব রোদ্দুরে দেওয়া হয়। ছোটবেলায় এই এক মজার বিষয় ছিল। রোদে দেওয়ার আগে সে গুলো ভালো করে কাচা হতো নাহ্ কোনো ড্রাইওয়াশ নয়। আগের দিন রিঠা ভেজানো হতো পরের দিন মা বাবা মিলে সেগুলো কাচত। কখনো কখনো বাড়ির কাকা পিসি দাদারাও সেই কাজে হাত লাগাতো বেশ একটা হইহই ব্যপার হত। আসলে তখন ছোটো ছোটো ঘটনাগুলো সবার সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে কোনো অস্বতি থাকত না। দিন বদলেছে পুরোনো কথা স্মৃতির অ্যালবামে জমা হয়েছে। এখন মেশিন কাচে আর আমি কাচের পাল্লায় চোখ রেখে দেখি স্মৃতিগুলো কেমন ঘুরতে থাকে। হিমেল হওয়ার কাঁধে ভর করে আমার শহরে ঝুপ করে সন্ধ্যে নামে। কুয়াশা গাঢ় হয়ে হ্যালোজেনের আলোয় বাসা বাধে। ছাতিম ফুলের গন্ধে বাতাস ভরে ওঠে আর রাতগুলো আরও মায়াবী হয়ে যায়। হঠাৎ কবিতার টেবিল কোনো এক বইয়ে তলায় পুরোনো রান্নার ডায়েরি পাওয়া যায়। এ পাতা ও পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখ আটকে যায় কেকের রেসিপিতে। 


 এখন যেমন প্রায় সব অনুষ্ঠানে কেক কাটার প্রচলন হয়েছে আগে তেমনটা ছিল না। তখন কেক আসত বড়দিনে। ২৫শে ডিসেম্বরের আগে কেক খাওয়া মানে মহাপাপ ঠিক যেমন সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাওয়া মানা। সে যাই হোক কেকের কথায় আসা যাক। বড়দিনের সকালে বাবা পাড়ার দোকান থেকে রূপোলি রাংতায় মোড়া কেক আনত। সেই কেক হত হালকা বাদামী রঙের তাতে কাজু কিসমিস আর বেশ কিছুটা টুটিফ্রটি  থাকত। তখন প্লাম কেক কাকে বলে জানতাম না। ছোটবেলায় একবার বাড়িতে কেক বানানোর মহাধুম পড়েছিল। সত্যি বলতে সেই কেকের স্বাদ মনে নেই তবে ভ্যানিলা এসেন্সের গন্ধটা নাকে লেগে আছে। আর রয়ে গেছে একটা বিনিদ্র দুপুরবেলার স্মৃতি। পিঠ সোজা করে ঠায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হত। ওদিকে প্রেসার কুকারে কেক হচ্ছে,কাঁটায় কাঁটায় চল্লিশ মিনিট বেক করতে হবে তা না হলেই মুশকিল। তখন তো ওভেনের অটোকাট ছিল না। তবে আজও এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। এখন অবশ্য প্লাম কেকের বাকি উপকরণ গুলো জানি। বুঝি ময়দা আর চিনির রেশিও অনেকটা দাম্পত্যের মতো। বয়েস বাড়ছে,বাড়ছে হিমেল হাওয়ার প্রতি মায়া। আসলে এই হিমেল  হাওয়া  যে পুরোনো স্মৃতিগুলোকে বড্ড উসকে  দেয়।  দেখতে দেখতে শীত আসে, বছর শেষ হয় ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যায়। আর গুনগুন করে মনে বাজতে থাকে “শুধু যাওয়া আসা ,শুধু স্রোতে ভাসা”।

30.6.22

পাহাড়ের বাসাখানি

গত বছর শেষের দিকে পাহাড়ে গেছিলাম সবাই যেমন যায় আর কি। তবে এমন কিছু ভ্রমণ থাকে যা নিজেকে চিনতে সাহায্য করে। বেড়াতে এসে বাইরের প্রকৃতিকে যে এত নিবিড় ভাবে পাব তা কখনো ভাবিনি। তাই এই ব্লগ কোন ট্রাভেল বা হোটেল রিভিউ নয় বরং খানিকটা নিজের অনুভূতির কথা ভাগ করে নেওয়া। আমাদের প্রত্যেকেরই প্রায় দুটো বাসা থাকে। একটা যেখানে আমরা শারীরিক অবসস্থান করি,রোজনামচার জীবন। চালটা তেলটা নুনটা নিয়ে যেখানে রোজ ঝগড়া বাঁধে। সে বাসায় চিল বসে না। কিন্তু আরেকটা হল মনের বাসা,যেখানে শুধুমাত্র নিজে থাকা হয়। চোখ বন্ধ আর খোলার মধ্যে এই বাড়ির গন্ডি। তবে যদি কখনো সেই বাড়িতে থাকার সৌভাগ্য হয় তাহলে তো কথাই নেই। তেমনই এক সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের ।
দার্জিলিং যতটাই জনবহুল মিরিক ততটাই শান্ত। অনেকেই সাইডসিনের তালিকায় রাখেন এই মিরিককে। তবে যারা একান্তে কাটাতে চান তাদের কাছে এ একেবারে স্বর্গ। পাহাড়ে বাড়ি কেনার শখ কার না থাকে? তবে কিনব বললেই তো আর কেনা যায় না সেক্ষেত্রে কয়েকটাদিন নিজের বাড়ি অনুভাবটা অবশ্যই পাবেন কোথায়? মিরিক বাজার থেকে পুলিশ থানার বাঁ দিক দিয়ে রাস্তা নেমে গেছে নিচে পাহাড়ী রাস্তার বাঁকে অভ্যস্ত নাহলেও পাইনের সারি দেখতে দেখতে কখন যে গন্তব্যে এসে পৌঁছবেন খেয়ালই থাকবে না। আমাদেরও ছিল না। গাড়ি একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াতেই হোমস্টেয়ের ম্যানেজার ও তার দুই সঙ্গী এসে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। তাদের সঙ্গে আমরা আরও কয়েক ধাপ নিচে নেমে গেলাম আর যা দেখলাম তা অবর্ণনীয়। হোমস্টেটি একেবারে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত। আকর্ষণীয় বিষয় হল এই হোমস্টেতে অ্যাপার্টমেন্ট অ্যাকোমোডেসানের সুব্যবস্থা রয়েছে যেমন ডেক অ্যাপার্টমেন্ট,টেরেস অ্যাপার্টমেন্ট,ষ্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদি। আমরা ছিলাম ডেক অ্যাপার্টমেন্টে। নিজেদের ঘর দেখবো বলে আমরা যখন তৃষ্ণার্ত চোখ নিয়ে ম্যানেজারের পিছু নিলাম তখন সূর্য পাটে।
পাহাড়ের উপর ঝুলন্ত একটা কাঠের বাড়ি।হ্যাঁ বাড়ি হোটেলের রুম নয়। তার কারণ না হয় ধীরে ধীরে বলি। মূল দরজার পাশে গাছের গুড়িতে যা লেখা তা বাংলায় দাঁড়ায় ‘পাখির গানের বাসা'। দরজা ঠেলে ঢুকতেই রয়েছে বসার ঘর যার একপাশে সোফা আর অন্যদিকে একটা মস্ত ডিভান সাথে টিভিও আছে যদিও পাহাড়ে তা নিষ্প্রয়োজন। বসার ঘরের একদিকে উঁচু প্লাটফর্ম পেরিয়ে রয়েছে অত্যাধুনিক সুবিধা সমেত রান্নাঘর অনেকটা ক্যাফে স্টাইলে যেটি আমার পুরো বাড়ির মধ্যে দ্বিতীয় পচ্ছন্দের জায়গা। প্রথম কোনটা সেটা পরেই বলব। এই হোমস্টের অন্যতম বিষয় যেটি অন্য হোমস্টে থেকে আলাদা করে দেয় তা হল ইন্টেরিয়র। প্রতিটি ঘর ভীষণ সুন্দর ও যত্ন করে সাজানো। বুকশেল্ফে রাখা বই,হলদে ল্যাম্পশেড,ইন্ডোর প্লান্ট,উডেন কোস্টার এসব দেখলে মনে হয় যেন নিজের বাড়িতেই আছি।
আসলে আমরা বেড়াতে গেলও নিজেদের অজান্তেই নিজের বাড়ি ও অভ্যেসগুলো মিস্ করি। আমাদের পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেছিল তাই ফ্রেশ হয়ে এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি এযেন চাঁদের হাট। একদিকে কার্শিয়াং বিপরীতে দার্জিলিং শহর। রাতের অন্ধকারে নাকি পাহাড় দেখা যায় না? আমি তো বেশ বুঝতে পারি তোকে। ঐ ছোট ছোট আলোগুলো দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন হাজার হাজার হীরে ঢেলে দিয়েছে। আর ওদিকে ঝকঝকে আকাশে তারাদের বৃষ্টি যদিও খালি চোখে তা বোঝা যায় না। ফটোগ্রাফির ভাষায় যাকে বলে star trail।
এই পাহাড়ী বাসখানিই আমাদের আগামী তিনদিনের বসবাস।আগেই বলেছি মানুষ যেখানে যায় সেখানেই তার সংসার নিয়ে যায়।আসল কথা হল নিজের অভ্যেস কাঁধে নিয়ে ঘোরে।আমিও স্বভাব মতোই মসলাপাতির একটা বাক্স নিয়ে গেছিলাম। এত গোছানো রান্নাঘরে রান্না হবে না তা কখনো হয়। বেড়াতে গিয়ে রান্না? অনেকেই ভাবতে পারেন এ আবার কি? ভাবুন তো সকালে যখন সামনের পাহাড়টা আপনাকে সুপ্রভাত বলবে আপনি তখন নিজের বানানো জলখাবার খাচ্ছেন। ভাব যায় ? আসলে একসময়ে মনে হয় চারদিকে ছোটাছুটি করা, সাইডসিনের পিছনে দৌড়ানো,ফোটোর জন্য ভাল লোকেশন খোঁজা এসব ছেড়ে শান্ত হয়ে কোথাও বসি। চুপ করে চেয়ে থাকি পাহাড়টার দিকে। কতদিনের না বলা সব কথা কত কান্না কত হাসি কত বিস্ময় সব যেন এমনি এমনি বেরিয়ে আসে। পাহাড়ের এই বিশালতার কাছে আত্মসমর্পণের মধ্যে কোন কুন্ঠা নেই। তাই আপন খেয়ালে চোখের কোণে জল জমে। এ জল কি দুঃখের না আনন্দের?মন বলে বিস্ময়ের!
হোমস্টের চারপাশে জঙ্গল। ঐ জঙ্গল বেয়ে প্রায় দেড়ঘণ্টা ট্রেক করলে একটা নামহীন ঝর্ণার দেখা মেলে। সত্যি বলতে এই ঝর্ণার আলাদা কোন বিশেষ্বত্ব নেই। তবে ঐ রাস্তাটা ভীষণ মায়াবী। পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার পথ।আর লম্বা লম্বা বাঁশগাছের পাহারা ভেদ করে সূর্যের আলো খুব কমই ঢোকে তাই কেমন ঠান্ডাভাব। সেই পথের সঙ্গী ছিল ব্রুনো (আমার বন্ধুর দেওয়া নাম)এক লমোস পাহাড়ি কুকুর। আমরা যে কদিন ছিলাম ও আমাদের সাথেই ছিল। এই হোমস্টের একটা জিনিস আমায় খুব অবাক করে তা হল অকৃত্রিমতা। পুরো হোমস্টেটি গাছপালায় ঘেরা,কিছু গাছের বয়েস বেশ পুরোনো আবার কেউ সদ্য জন্মেছে। চাইলেই ওনার অন্যভাবে সাজাতে পারতেন যেমন সুদৃশ্য বাগান যেখানে সব গাছের গোড়াগুলোকে এক রঙ করা হয়ে থাকে কিংবা দামী পাথর দিয়ে ঘেরা ফোয়ারা ইত্যাদি। কিন্তু তা হয়নি মজার বিষয় হল যেখানে যে গাছ বেড়ে উঠেছে তাকে সেখানেই বাড়তে দেওয়া হয়েছে। শুধু বাণিজ্যের স্বার্থে তাকে সুন্দর করে তোলার অহেতুক চেষ্টা করা হয়নি। দামী ও অত্যাধুনিক আসবাব অবশ্যই রয়েছে আসলে পাহাড় ঘেরা জঙ্গলকে বাসায় পরিণত করতে হলে খরচ তো হবেই তবে নান্দীকতা বজায় রেখে। বনে যদি বন্যতাই না থাকল তাহলে আর লাভ কি।
এবার আসি এখানে যে জায়গাটা আমার সবথেকে বেশি ভাল লেগেছে। সেটা এই অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দা যেখান থেকে আমি রোজ চাক্ষুষ করতাম আমার প্রেমিক পাহাড়কে। একবুক আকাশ তাকে আগলে রেখেছে আর যুবতী মেঘেরা মাঝে মাঝে এসে তাকে ঢেকে দিচ্ছে। কত রঙ পাহাড়ের!বেলা বাড়ার সাথে সাথে এক একটা রঙ নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। হোমস্টেয়ের ম্যানেজার মানুষটি খুবই ভালো ছিলেন দায়িত্ব নিয়ে সব বাজার করে দিতেন। আমরাও বেশ মাংসে ভাতে বিরিয়ানিতে জমিয়ে পেটপুজো করতাম। দুপুরগুলো কাটত লেবু বাগানে। এই হোমস্টেতে যারা রান্নাসহ অন্য কাজ করতেন তার সবাই পাশের গ্রামের লোকজন।
একদিন সকালে দেখি এক অল্পবয়সী মেয়ে এসে হাজির ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য। সেদিনই আমার প্রথম বিশুর সাথে আলাপ। ও আমাকে ওর বাড়ির কথা বলত, বলত ওর বরের কথা চার বছরের ছেলের কথা আর খুব হাসত। ও আধা নেপালি আধা হিন্দিতে কথা বলত আর আমিও নেপালিতে এটাকে কি বলে ওটাকে কি বলে প্রশ্ন করে ওকে পাগল করে দিতাম। আমাদের ঐ নির্মল কথপোকথন গুলোর জন্য আজও অপেক্ষা করি।
পাহাড়ে কেমন যেন ঝুপ করে সন্ধে নামে। গোটা হোমস্টেটা আলোয় সেজে উঠত। বন ফায়ারে জলন্ত কাঠের আওয়াজ আর ঝি ঝি পোকার ডাক সঙ্গে বারবিকিউ আর সাথে আমার বেসুর ইউকেলীলি বেজে উঠত চেনা গানের কথায়। দূরে কালোচাদর মুরি দিয়ে পাহাড় হেসে বলত আর কদিন বাকি ফেরার? স্বর্গীয় সুখ চিরন্তন নয়। তাই বিদায় নিতেই হল। মেঘেরাও বুঝেছিল আজ আমাদের ফেরার দিন তাই ভোর থেকেই পাহাড়টাকে জড়িয়ে রেখেছিল। অগত্যা পাহাড়কে দেখা হল না। ফেরার পথই বলে পথ শুরুর গল্প। নাহ্ মন খারাপ হয়নি ফিরতি পথে চা বাগানের অলিগলিতে একটু জিরেয়ে নেওয়া। ওখানে বসে মনে হচ্ছিল যা দেখছি যা অনুবভ করছি যদি সবটুকু লিখে রাখতে পারতাম!এই আফসোস চিরকালীন। এয়ারপোর্টে গাড়ি এসে থামল তারপর ধীরে ধীরে গন্তব্যে এগোনো। সিকিউরিটি চেকইন হয়ে গেছে ফ্লাইটেও বসে পরেছি যেই টেকঅফ হল অমনি আমার চোখ বুজল আর সামনে সেই একরোখা খটখটে পাহাড় যে আমাকে কখনো একা ছাড়ে না। আর তার কোলে উঁকি মারছে আমার একরত্তি পাহাড়ের বাসখানি।

19.11.21

ভিড়ের মাঝে একলা হওয়া

বেড়াতে যাওয়া মানেই চোখ বন্ধ করে কদিনের জন্য রোজকারের জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া। সেই রকম ইচ্ছে করল আমাদের। আমাদের মানে , আমি আর আমার কর্তা । কিন্তু কোথায় যাবো? মনের সব প্রশ্নের উত্তর দিল গুগুল। একটা ক্লিক আর কৌতূহলের সমাপন। ঠিক হল বেনারস। সময়টা ছিল নভেম্বর মাস, শীতের চাদর জড়িয়ে চেনা শহরকে বিদায় দিয়ে ট্রেন স্টেশন ছাড়ল। মানুষ যেখানে যায় সেখানেই নিজের মতো একটা সংসার বানিয়ে নেয়। কামরায় ঢুকতেই দেখি দুজন মারওয়ারী মহিলা প্রাতরাশ সারছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে বাংলা হিন্দি মিলে গেল। সবুজ মাঠ পেরিয়ে, খাল পেরিয়ে ট্রেন ছুটছে সাঁ সাঁ। শহুরে কোলাহল ডুব দিয়েছে ট্রেনের ঘর্ ঘর্ শব্দে। ছোট্ট জানলার ক্যানভাসে ধরা পড়ছে নানা ছবি। সবুজ ধানক্ষেতের রং ক্রমশ হালকা সবুজ,হলুদ হয়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও সবুজের মধ্যেই লালের পারদ বেশি চড়িয়ে বাদামি তার জায়গা করে নিয়েছে । মালভুমিগুলো জানান দেয় গৃহ রাজ্যটি থেকে বিদায় নিয়েছি আমরা। সূর্যদেব গুটিগুটি পায়ে হাঁটছেন,বেলা বাড়ছে। ট্রেনে বসে সূর্যাস্ত দেখতে অপূর্ব লাগছিল । ধীরে ধীরে আমাদের গন্তব্য এসে হাজির। ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম তখন প্রায় আটটা বাজে। হোটেলে যেহেতু বলা ছিল তাই অল্প সময়ের মধ্যেই টোটো এসে গেছিল। গাড়িতে যেতে যেতে অচেনা শহরের ভূমিকা পেলাম। চারপাশে শপিংমল,বিদেশি ব্রান্ডের দোকান, সিগন্যালে বিরক্তি সবকিছু পেরিয়ে টোটো চক্ নামক জায়গায় এসে দাঁড়াল। সেখান থেকে মিনিট দশেক হাঁটা তারপরই হোটেল অলকা। হাঁটতে হবে কেননা রাস্তা গলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে কোনোরকমে হোটেলে পরিচয় পর্ব সেরে রুমে গেলাম । তারপর সাময়িক ফ্রেশ হয়ে খিদের তাড়নায় নীচে আসা।
এই হোটেলের বিশেষ আকর্ষণ হল গঙ্গার ঘাট। আসলে হোটেলটি একেবারে ঘাট লাগোয়া। এর খাবার জায়গাটা খুব মনোরম,কিছুটা ছাদ খোলা জায়গায় চেয়ার টেবিল পাতা আবার ভিতরেও বসে খাবার ব্যবস্থা আছে। তবে আমরা উদাত্ত গঙ্গাকে দেখতে দেখতে তারা ভরা আকাশের নিচে রাতের খাবার সারলাম। ঐ সময়টা ছিল ছট্ পুজোর আগের দিন। তাই কত মানুষ রাত থাকতেই ঘাটে এসে হাজির হয়েছে পরে দিনের পুজোর জন্য । নতুন সকাল যেন নিজে দুহাত দিয়ে চোখ খুলে দিল। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম মা গঙ্গার বুকে সূর্যের আলো যেন লক্ষ লক্ষ হীরে হয়ে ঝলমল করছে। নদীবক্ষে ভেসে চলছে অজস্র নৌকা। ভোরের বেনারস যেন স্বপ্নের মত যেমন শান্ত তেমনি নরম। বিচিত্র সব ছবি কেউ সুর্য প্রণাম সারছে আবার কেউ হয়তো চায়ের পেয়ালায়ে শেষ চুমুক দিচ্ছে। গাইডরা পর্যটকদের নিয়ে বেরিয়ে পরেছে। কথিত আছে মহাদেবের নগরী এই বেনারস। শহর জুড়ে রয়েছে মন্দির,তার মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ হল কাশী বিশ্বনাথের মন্দির। সভ্যতা সংস্কৃতির পীঠস্থান হল এই বেনারস। গঙ্গার দুই উপনদী বরুণা ও অসি দুয়ে মিলে বারাণসী। এই শহরের নামকরণ নিয়ে লোকমুখে রয়েছে আরও কাহিনী। অনেকের মতে ভারতের তীর্থস্থান গুলির মধ্যে অন্যতম পুণ্যভূমি হল এই বেনারস। এছাড়া ভক্তি আন্দোলনের রেশও এই ভূমিতে পাওয়া যায়।
আমার মনে হয় ঘুরতে এসে যদি পায়ে হেঁটে এলোমেলো না ঘুরলাম ,তাহলে কোনো মজাই নেই। তাই বেরিয়ে পড়লাম গাইডবিহীন ভ্রমণে  এই শহরের অলিগলি যত ঘুরছি ততই মনে হচ্ছে যেন ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠচ্ছে। রাস্তার দুধারে সারি দিয়ে দোকান। কোথাও গনগনে আগুনে দুধ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। আবার কোথাও ছাঁকা তেলে ফুলে উঠছে কচুরি। কোথাও বিদেশীদের ক্যামেরায় ধরা পড়ছে দেশীয় সাধুবাবার বিভিন্ন ছবি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা শিব পার্বতী সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘাটের পাশে রয়েছে দোকান পুজোর সামগ্রী, হার কানের দুল টুকিটাকি জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে। আবার অনেক নৌকায়ও এসব বিক্রি হচ্ছে। এইসব দেখতে দেখতে দুপুর কখন যে সদ্য বিকেলকে ছুঁয়েছে খেয়াল করিনি। চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘাট ভ্রমণে। যাত্রা শুরু হল মীর ঘাট থেকে। তারপর দশশ্বমেধ, ললিত,অহল্যাবাই,রাজা হরিশ্চন্দ্র,অসি ঘাট আরও কত। এক একটা ঘাট যেন ছবির মতো। ক্লান্ত পা কে আরাম দিতে নৌকা ভ্রমণ আবশ্যক। নৌকায় যেতে যেতে মনে হল ঘাট গুলো যেন চলচ্ছবি। নৌকায় বসে সূর্যাস্ত দেখলাম, সে অনুভূতি লেখায় প্রকাশ করা যাবে না। এর মধ্যেই দশশ্বমেধ ঘাটে সন্ধ্যা আরতি শুরু হয়েছে। ধূপ ধূনা আর ঘন্টা ধ্বনিতে মুখরিত ঘাট চত্বর। কত মানুষ ভিড় করেন এই আরতি দেখার জন্য। পিতলের ধূনচি,প্রদীপ,কর্পূরদানি প্রত্যেক দিন ব্যবহৃত হয়।
ধীরে ধীরে নৌকা ভিড়ল মনিকর্নিকা নামক ঘাটে,সেখানেও আগুন জ্বলছিল। তবে সেটা ছিল চিতার আগুন। মাঝির মুখে শুনলাম এই ঘাটে মৃতদেহ দাহ করা খুব পুণ্যের। এই ঘাটে মৃতদেহ দাহ করলে নাকি মুক্তি প্রাপ্ত হওয়া যায়। আরও বললেন যে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে দেবী পার্বতীর কুন্ডল এখানে হারিয়ে গেছিল। অনেক খোঁজার পরও পাওয়া না যাওয়ায় মহাদেব প্রচন্ড রেগে সমুচী জাতিকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে তারা মৃতের মুখে অগ্নিদান করবে। সেই থেকে এই জাতি ডোম জাতি নামে পরিচিত। একটা ঘাটে পূজা অর্চনা আর অপর ঘাটে জীবনে চরম সত্যের মুখোমুখি। নৌকায় বসে চিতার ওই আগুন দেখছিলাম। আর মনে হচ্ছিল এই আগুনে মানুষের সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অথচ জীবিত থাকাকালীন আমরা আমাদের আমিত্বটুকু পোড়াতে পারি না। সারা শরীরে কেমন নিস্তব্ধতা বাসা বেঁধে ছিল।
নদীতে অবসন্নতাকে ভাসিয়ে দিয়ে হোটেলে ফিরেছিলাম। পরের দিন সকালটা একটু অন্যভাবে হয়েছিল। ঘুম ভাঙল তবলার আওয়াজে, হোটেলের লাগোয়া বাড়ি থেকে ওই সুর আসছে। সাত সুরের লহমায় সকাল ভরে উঠল। বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম একজন জাপানি মহিলা ছবি আঁকছেন। কাছে গিয়ে দেখলাম তিনি একজন বয়স্ক লোকের ছবি আঁকছেন। তার টেবিলে রং তুলি। ওয়েটার এসে কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করায় তিনি এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। আসলে ভাষা যে কোন বাধা হতেই পারে না তা আবার প্রমাণিত হল। বেনারসে এসে পান খায় নি এমন মানুষ বোধহয় নেই। চক্ এর কাছে একটি মসজিদ আছে তার ঠিক পাশেই আছে বেনারসী পানের দোকান। দোকানে থাকা লোকটির মুখ থেকে জানতে পারলাম এই দোকানটি তার প্রায় তিন পুরুষের। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই এই দোকানের জন্ম।পরাধীন ভারতে বেশ কিছু পত্রিকা ইংরেজ সরকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল।শোনা যায় তখন এই বেনারসি পান কাগজে মুড়ে এবং তাতে কাগজ পুড়ে বাড়ি বাড়ি বিতরণ করা হত। ভ্রমণের সাথে ভোজন কথাটিকে অগ্রাহ্য করলে মোটেও চলে না। একটা বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় ঘাটের ধারে যে হোটেল বা লজ আছে তাতে নিরামিষ রান্নাই বেশি পাওয়া যায়।তবে একটু দূরে আমিষ রান্নাও আছে। তবে আমার মূল আকর্ষণ ছিল রাস্তার ধারের খাবার গুলো।পুরি সব্জী সাথে জিলিপি আর লস্যির স্বাদ তো ভোলার নয়। তবে একটা নতুন জিনিস খেয়েছিলাম তা হলো নিমিস।দুধের ফেনা দিয়ে তৈরি এক জিনিস।শুধু যে ফেনা তা নয় তবে বেশি কিছু বোঝার আগেই মন এত তৃপ্ত হয়েছিল যে আর উপকরণ খুঁজি নি।
বেনারসের থেকে কিছু দূরত্বে রয়েছে বেনারস ইউনিভার্সিটি ও রামনগর দুর্গ। ১৭৫০ সালে রাজা বলবন্ত সিং মুঘল আদলে তৈরি করেন এই রামনগর দুর্গ। গঙ্গার পূর্ব তীরে তুলসী ঘাটের কাছে এটি অবস্থিত।আমরা যেদিন গেছিলাম সেদিন এই দুর্গে শুটিং চলছিল তাই বেশ কিছু জায়গায় যাওয়া নিষেধ ছিল। তবে এই দুর্গের ভিতর একটি সংগ্রহশালা আছে। আমরা টিকিট কেটে ঢুকে পড়েছিলাম সেখানে।কত ধরনের পালকি দেশী বিদেশী গাড়ি চোখে পড়ল। এছাড়াও আছে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ধরণের তলোয়ার বন্দুক বর্শা। সব মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক অস্ত্র। সোনা রূপায় সুতোয় বোনা রাজা মহারাজদের পোশাক, চাদর। চোখের সামনে রাজকীয় পরিবেশ পরখ করেছিলাম। এ ঘর ও ঘর ঘুরতে ঘুরতে প্রায় বিকেল হয়ে গেছিল। সন্ধেকে কাধেঁ নিয়ে হোটেলে ফিরেছিলাম।



দেখতে দেখতে ছুটিও শেষ এবার ফেরার পালা  বেনারসে কাছে পিঠে অনেক ঘোরার জায়গা থাকলেও আমার মূল আকর্ষণ ছিল ঘাটগুলো। মানুষের জীবনযাত্রার সাথে ঐ ঘাট গুলো কিভাবে জড়িয়ে গেছে তাই লক্ষ্য করছিলাম  নভেম্বরের মাঝামাঝি দেবদীপাবলি অনুষ্ঠান হয়। তাতে এই সমস্ত ঘাট গুলো সেজে ওঠে লক্ষ লক্ষ প্রদীপে। দেশ বিদেশে থেকে মানুষ আসে তা দেখতে। আমাদের হাতে সময় না থাকায় এই আক্ষেপ রয়ে গেল। নৌকা গুলো নতুন রঙে সেজে উঠেছে। চারপাশে একটা উৎসবের আমেজ।
আপাত ভাবে দেখলে বেনারস বা কাশী খুবই জনবহুল একটি জায়গা। কিন্তু এই শহরের গলিগুলো, চলটা ওঠা পুরোনো বাড়ি, দোকানে ঝোলানো বিক্রি না হওয়া বেনারসী শাড়ি, রাতে নিভে আসা আলোয় নির্জন ঘাট এসব দেখলে ভিড়ের মাঝে একলা হতে ইচ্ছে করে । এখন প্রায় বছর তিনেক হল বেনারস ভ্রমণের। আজও রোজকার ব্যস্ততা মনখারাপের চাপান উতরে যখন একা লাগে তখন মনে পড়ে ওই ঘাটে বাধা নৌকাটার কথা। জলের তোড়ে দুলে উঠলেও বাঁধন ছিঁড়তে পারে না মাঝির অপেক্ষায় থাকতে হয়। অনেকটা আমাদের মতোই তাই না ?

ছবি : নবারুণ মাইতি 

23.12.20

ঠিকানাহীন চিঠি


পরম
প্রিয় অরিন্দম,

                                       চারপাশে একটা দম বন্ধ করা পরিস্থিতি। মনে হচ্ছে অদৃষ্ট যেন কালো কাপড়ে ঢেকে দিয়েছে সবকিছু। মনে হচ্ছে কেউ যেন অন্ধকার একটা ঘরে আটকে রেখেছে। কোনো দিকে যাওয়ার জো নেই তবুও আমি তোমায় চিঠি লিখছিএকটা ঠিকানাহীন চিঠি

অরিন্দম এমন কেন করলে?  কেন নিজেকে আড়ালে রাখছ? কেন নিলে স্বেচ্ছায় নির্বাসন? কেন কিছু বলো নি আমায়?  যদিও তুমি কিছুই বল নি কোনোদিন কখনও। তুমি বলেছ –‘ বলার কি আছে?’ বলার কি কিছুই থাকে নাপ্রকাশ শব্দ তোমার অভিধানে নেইকিন্তু কত বোঝা যায় বলতোএই কানগুলো শুনতে চায় কথা তবে কিছু যে বল নি তা নয়, বলেছ। যেদিন আনত মুখে তোমার জন্য অপেক্ষায় , ঘরের দরজা ঠেলে বলেছিলে কাছে এসআমার কানে যেন সহস্র শব্দ তীরের বেগে খেলে গিয়েছিলচোখের সামনে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিলসেই স্মৃতি আজও হলুদ হয় নিকিন্তু একি হলো তোমার?  নির্বাসনে যদি যেতেই হয় আমিও যাবোশ্রীরামচন্দ্র কি একা গেছিলেন সীতা মা তো সঙ্গে ছিলেনকিন্তু তুমি বললে-‘ না শ্রীতমা আমাকে একাই যেতে হবে।' আমি যাই নিআমি ঘরে একাকীভোরবেলায় এক কাপ চা নিয়ে বসি আমার বারান্দায়তুমি ভাবছ এখনও সকালে ওঠার কি আছে? আগে উঠতাম তোমার ডিউটির জন্য, এখন অভ্যেসমানুষ যে অভ্যেসের দাসচা খেতে খেতে আমার চার বাই ছয়ের বারান্দায় ঘুরপাক খাইগাছে জল দিইদশটা বাজে রান্না বসাই চাল ডাল আলু সেদ্ধ হয়প্রেসারে সিটি পরে আমার মনে পড়ে আমাদের প্রথম দেখা হওয়াএক  সরস্বতী  পুজোয় বইমেলার নাম করে তোমার সাথে কাটানো পড়ন্ত বিকেল। কিংবা সোনাঝুড়ির মাঠে কোনো এক দোলে দুজনের হারিয়ে যাওয়া আবিরের রঙেসেই রঙের প্রতিটি সোহাগ লেগে আছে নীল ডুরে শাড়ীতেসেই শাড়ী এখন আলমারির তাকে কাঁদছে

 দুপুর গড়ায় বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকে কবিতারাতারা হেঁটে চলে আমার শরীর জুড়ে। আমার ঠোঁটের গভীরে স্বরকে স্পর্শ করে । চোখের গহ্বরে জেগে ওঠে চোখতোমার চোখ আমি অনুভব করি , অনুভব করি ঘ্রানকোনও এক শীতের আচারি দুপুরে নিবিষ্ট হয়ে ছিলাম দুজনেনারকেল পাতার ছায়ায় ভেসে উঠেছিল তোমার খোলা বুকঝড়ের রাতে আমি এখন ওই বুক খুঁজিএক এক করে দিন কাটেস্মৃতিরা পিছু হাঁটেতুমি বলেছিলে –‘ সেবাই আমার ব্রত’। আমি প্রশ্ন করেছিলাম-‘ কেন তুমি ডাক্তার বলে’? তুমি বলেছিলে –‘ শ্রীতমা আমার কাছে এসো না এই ভাইরাস মারাত্মকযদি শরীরে বাসা বাঁধে শেষ করে দেবে সব’।

আমার মনে আছে যেদিন তুমি হসপিটাল থেকে ফিরছ, আমার মনে আনন্দটানা আঠ দিন বাদে বাড়ি ফিরছ তুমিটেবিলে রেখেছিলাম পদ্ম পোরসলিনের বাটিতেরাতের মেনুতে তোমার পছন্দের খাবাররেশমের চাদরে ঢেকেছে নরম গদিতুমি এলে মুখ থমথমে শার্টের বোতাম ছেঁড়াসমস্ত ঘটনা শোনার পর কি বলব আমি বুঝতে পারি নিচরম রাগে ভেঙে ফেলেছিলাম পোরসলিনের বাটিতুমি স্বাভাবিক স্বরে বলেছিলে-‘ এত রাগ কর কেন? ওদের কি দোষ ওরা তো সাধারণ মানুষবেঁচে থাকার লড়াইটা যে বড্ড কঠিন।'  কথা তুমি বলতে পারোচিরকাল অন্যের কথাই ভেবে গেলে কিন্তু ওরা ভাবে নি তোমার কথাযে হাউসিং - এত দিনের বাসতারাই বেঁকে বসলতারা ঢুকতে দেবে না তোমাকেতোমার থেকেই নাকি ছড়াতে পারে সংক্রামণতাই তুমি নিলে স্বেচ্ছায় নির্বাসনআমি জানি এটা স্বেচ্ছায় নয়, এটা বাধ্য হয়েআমি চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে ছিলামমনে হল যে মানুষরা আক্রমন করল তোমায় তারা কি দেখল না তোমার ডাক্তারে পরিচয়ের পিছনে একটা মানুষের শরীর আছেযেটা তাদের বহু পরিচিতবিগত দিনের কোন স্মৃতিই কি তাদের চোখে ধরা পড়ে নি? বিষন্নতায় নিজের নখ উপরে আসে হাতে উত্তর পাই না

 সেদিন হঠাৎ করে কি বৃষ্টি শুরু হলআচ্ছা ওই বৃষ্টি কি তুমি পাঠিয়েছিলসেই কি আমার মেঘদূতআমি বৃষ্টিতে ভিজি চোখের জল গুলো লুকিয়ে যায় সহজেইআমি জানি তুমি রাগ করেছতোমার এত বছরের জীবিকা জীবন ধারণ সব কিছু তোমার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছেতুমি বলেছিলে –‘ শ্রীতমা আমি মৃত্যুকে ভয় পাইআমি আর দেখতে পারছি না মৃত্যুগোটা পৃথিবী জুড়ে যেন লাশের মেলা বসেছেআমার গা গুলিয়ে উঠছে আর আমি নিরুপায় ডাক্তার।'  ভুল কথা, তুমি ধন্বন্তরি। আমি তোমাকে দেখেছি রোগীর মৃতদেহের সামনে যখন পরিবারের কান্না তুমি ঘুষি মেরেছ করিডোরের দেওয়ালেতোমার বিনিদ্র রাতের সাক্ষী আমিতুমি মৃত্যু দেখেছ কিন্তু তার পাশে বসে থাকা অন্য এক বাবাকে দেখ নি যে তখনও বিশ্বাস করে ডাক্তার মানে দেবতাতুমি হাহাকার শুনেছ নবজাতকের কান্না শোনো নিতুমি যে কান্ডারি অরিন্দম তুমি ফিরে এসো , ফিরে এসো তোমার সাধের হসপিটালে, তোমার রোগীদের কাছে, তোমার ঘরেএকদিন তোমায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি কে তোমার? তুমি বলেছিলে-‘ আমার ঘুম ভাঙানিয়াজীবনের কাছে ফিরে এসো অরিন্দম  ফিরে এসো ভালোবাসার কাছে হাজার ঝড়ে হাজার বন্যায় বা খরায় পুড়ে গিয়েও ভেসে গিয়েও সে আজও মাথা তুলে দাঁড়ায়সে আজও প্রেমের রাখি বোনে সেই রাখি নিজের হাতে বেঁধে নাও অরিন্দম আর হয়ে ওঠ মৃত্যুঞ্জয় কারণ প্রেমই পারে ধ্বংসের মধ্যে সৃষ্টির বীজ বুনতেপ্রেমই পারে মৃত্যুকে জয় করে নীলকন্ঠ হতে

 ইতি,

 অপেক্ষারত তোমার

 ঘুম ভাঙানিয়া

 



ছবি : সংগৃহীত